শুরুটা হয়েছিল ১৯৯৮ সালের ২৮ আগস্ট। শুক্রবার। চারুকলার দ্বিতলে। উপস্থিত ছিলাম আমরা ৪২ জন। একটি মাত্র স্বপ্ন ছিল সবার চোখে- এ অঞ্চলের মানুষের সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা। আর সে লক্ষ্যে চলমান গ্রুপ চর্চা থেকে আবৃত্তি শিল্পকে প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার পথে নিয়ে যাওয়া।
আবৃত্তিকে বলা হয় সকল পারফর্মিং আর্ট বা শিল্পের মূল শিল্প। শুদ্ধ উচ্চারণ এবং বাচনিক উৎকর্ষ ছাড়া কোন পারফর্মিং আর্টে সফল হওয়া যায় না। আর যদি থাকে আবৃত্তি জ্ঞান তাহলে সেই ব্যক্তি পারফর্মেন্সে এগিয়ে থাকবে অন্যদের চেয়ে। হয়ত এই কারণে কিংবা আমরা সবাই আবৃত্তিপ্রেমী ছিলাম বলে একটি আবৃত্তি সংগঠন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই খুঁজছিলাম সাংস্কৃতিক মুক্তির পথ। আমার মনে পড়ে, আমি সেই দিন সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর আত্মবিশ্বাস ও জাতীয় প্রতিষ্ঠা প্রবন্ধের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিলাম, আমাদের যদি আত্মবিশ্বাস থাকে তাহলে এই প্রয়াসে আমরা সফল হবোই।
কিন্তু শুরুতেই বিপত্তি বাঁধে। দ্বিতীয় মিটিং এ উপস্থিত ছিলাম ৪২ জনের মাত্র ৩(তিন) জন- আমি, বিপ্লব দা এবং তুহীন ভাই। আর ছিল আমার বন্ধু জসিম। এই মিটিংটি হওয়ার কথা ছিল বিশ্ব-সাহিত্য কেন্দ্রের ছাদে। সংখ্যাল্পতার কারণে মিটিংটি শেষ পর্যন্ত হয়নি। তারপর থেকে ধীরে ধীরে এগুতে থাকি আমরা। আমি, বিপ্লব দা, জয়, তুহীন ভাই প্রথম দিনের এই চারজনের সাথে যোগ হতে থাকে শুক্লা দি, আরু ভাই, মাসুদ, টুম্পা, রাজন, নিপুণ, কাকলী আপা, জসিম সহ আরো অনেকে। আমরা এগিয়ে যাই আমাদের প্রথম প্রযোজনা সূর্যদীঘল বাড়ির প্রথম ও দ্বিতীয় মঞ্চায়নের দিকে। নির্দেশনা দেন বিপ্লব দা।পারফর্ম করি আমি, বিপ্লব দা, শুক্লা দি, আরু ভাই, নিপুণ, টুম্পা এবং প্রথম দিন জয় ও দ্বিতীয় দিন মাসুদ।
প্রথম দিকে সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর চেয়ে আমরা নিজেদেরকে আবৃত্তি শিল্পী হিসেবে গড়ে তোলার দিকে জোর দেই বেশি। ফলে ২০০০ সালের আগস্টের দিকে আমাদের সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র চৌদ্দ/পনের জনের মত। আর এই সময়ে ঘটে দ্বিতীয় বিপত্তি।শুক্লা দি আর বিপ্লব দা’র বাইরে প্রথম পরিচালক হন আরু ভাই। তার পরিচালক হবার পরপরই দৃশ্যপট বদলাতে থাকে। বিপ্লব দার সাথে আরু ভাইর প্রবলেম হতে থাকে। দলীয় কাগজপত্র এবং হিসাব নিয়ে দুজনের দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে। এরই এক পর্যায়ে নভেম্বরের শেষদিকে গ্রুপের সাপ্তাহিক আবৃত্তির আসরে হঠাৎ বিপ্লব দা ঘোষণা করেন, দলে এখন থেকে আর গণতন্ত্র চলবে না। তিনি যা বলবেন তাই আইন। সংবিধানের আর কোন প্রয়োজন নেই। তার কথার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে কিছু সদস্য তার সাথে আবৃত্তির আসর ত্যাগ করে উঠে চলে যান। সেদিন তার সাথে চলে গিয়েছিল- সুমন, সুদীপ, নিপুণ, এবং পরবর্তিতে তৎকালীন দলের সমন্বয়ক জয়।শুক্লা দি সেদিন অনুপস্থিত ছিলেন। পরবর্তিতে তিনি বিপ্লব দা’র সাথেই আবৃত্তির চর্চা চালিয়ে যান। আর আমরা যারা সেদিনের আবৃত্তির আসরে বসে ছিলাম তারা হল আমি, তখনকার দলের পরিচালক আরু ভাই, মাসুদ, জুঁই, পিউলী, নিম্মি। রাজন এবং জসিম সেদিন উপস্থিত ছিল না। পরবর্তিতে তারা আমাদের সাথে আবৃত্তির চর্চা চালিয়ে যায়। বিপ্লব দা’রা এখন হরবোলা নামের একটি সংগঠনের ব্যানারে আবৃত্তি চর্চা করলেও এখনো তারা ২৮ আগস্টকেই প্রতিষ্ঠার দিন হিসেবে পালন করেন।
বিপ্লব দা’র সাথে সেদিন একাত্ম হতে না পারা আমার জন্য ছিল খুব কষ্টের। কারণ তার এমন সিদ্ধান্ত আমাদের চলার পথ আলাদা করে দেয়। সে সময় দলের প্রতিটি ইভেন্টে আমি ছিলাম সবচেয়ে সক্রিয়। নতুন আবৃত্তিকর্মী তৈরির পাশাপাশি কর্মশালা বাস্তবায়নে আমি সবচেয়ে বেশি সময় দিতাম। একটা নতুন প্রযোজনায়ও হাত দিয়েছিলাম, যেটা পরবর্তিতে আমরা ‘শব্দের চোখে জল’ নামে মঞ্চায়ন করি। মনে আছে প্রথম বছর আমাদের সাপ্তাহিক আবৃত্তির সিটিং হয়েছিল ৪২ টি। আর আমি উপস্থিত ছিলাম ৪৪ দিন। দু’দিন আমি একা উপস্থিত থাকায় সিটিং হয়নি। বিপ্লব দা’র ওই তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত বড় ধরণের ঝাঁকুনি দেয় আমাকে। আমি শুক্লা দি’র সাথে যখন বিষয়টা শেয়ার করি চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলাম না। আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ, মজুমদার জুয়েল দা’ কয়েকবার উদ্যোগ নিয়েছিল আমাদের দুই গ্রুপকে আবার এক করে দিতে। আমি বরাবরই আমার আগ্রহ দেখিয়েছি এক হয়ে যাবার জন্য। এমনকি পরবর্তিতে যখন আমাদের ষষ্ঠ কর্মশালা থেকে দলের কার্যক্রম ব্যাপকতর হতে থাকল তখন আমি নিজেও বিপ্লব দা’র সাথে কথা বলে আবার এক সাথে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করি। বিপ্লব দা’ও সেই প্রচেষ্টাগুলোকে পজিটিভ দৃষ্টিতেই দেখেছিলেন। কিন্তু কোন এক অজানা কারণে আমাদের চলার পথ ভিন্নই থেকে যায়।
আবৃত্তি একাডেমির কাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে মূলত ষষ্ঠ কর্মশালা থেকে। ওই সময় আমি আবৃত্তি একাডেমীর কাজে গতি এবং সমন্বয় আনার জন্য বেশ কয়েক দফা প্রস্তাব পেশ করি। যেগুলো গৃহিত হলে দলের কাজের গতি বেড়ে যায় বহুগুণ। তুষার মিজান হাসপাতালের বেড থেকে উঠে এসে অসুস্থতাবস্থায় ষষ্ঠ কর্মশালা বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেয়। সে সময় একই সাথে আমি, মাসুদ, তুহীনও ছিলাম দারুণ সক্রিয়। কর্মশালার শিক্ষার্থীদের সাথে সার্বক্ষণিক প্রশিক্ষক হিসেবে থাকি আমি। এই কর্মশালা থেকেই উঠে আসে জুয়েল, শামীম মাহমুদ, তাহমিনারা। যদিও জুয়েল কর্মশালার আগ থেকেই দলের কাজের সাথে যুক্ত ছিল।
এ সয় থেকেই নিয়মিত আবৃত্তি প্রযোজনার পাশাপাশি কর্মশালা বাস্তবায়নের প্রতি গুরুত্ব দেই আমরা। এভাবেই ধীরে ধীরে আবৃত্তি একাডেমী আজকের পর্যায়ে এসে পৌঁছে। গত বছর আমি আবৃত্তি একাডেমীর জন্য স্বল্প মেয়াদী, মধ্য মেয়াদী এবং দীর্ঘ মেয়াদী কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করি। এর মধ্যে স্বল্প মেয়াদী পরিকল্পনাটি খুঁটিনাটি সহ গত কাউন্সিলে উপস্থাপন করলে দলের কার্যকরি পরিষদ তার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে।
আমরা আশাবাদী! কোন অশুভ শক্তি দলের ভেতর মাথাচাড়া দিয়ে না উঠলে বা বাহিরের কোন প্রবল শক্তি আমাদের টলিয়ে না ফেললে আমরা ধীরে ধীরে ঠিকই এ অঞ্চলের মানুষের সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা অর্জনের পথে অবিচল হেঁটে যাব।