১৯৭৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন অঞ্চলের মরিচঝাঁপি দ্বীপে সংঘটিত একটি হত্যাকান্ড- যেখানে বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা বাঙালি হিন্দু শরণার্থীদের বলপূর্বক উচ্ছেদের জন্য পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন বাম সরকার (সংক্ষেপে সিপিআই(এম)) পুলিশ বাহিনীর সহায়তায় দ্বীপটি ঘেরাও করে। শেষে দীর্ঘদিন অবরোধের ফলে খাদ্য অপ্রতুলতায় অনাহারে এবং পুলিশের অনবরত গুলিবর্ষণের মুখে দ্বীপের অনেক মানুষ মৃত্যুবরণ করে।
দেশভাগ এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে বহু বাঙালি শরণার্থী হিন্দু তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসে। প্রথম সারির উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেনীর বাঙালী হিন্দু শরণার্থীরা সহজে কলকাতায় ও পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য এলাকায় নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করতে পারলেও পরবর্তী সারির বিশাল জনসংখ্যার নিম্নবিত্ত শ্রেণীর নমঃশূদ্র হিন্দুদের পশ্চিমবঙ্গে থাকতে দেওয়া হয় নি। বলপূর্বক তাদের পশ্চিমবঙ্গের বাইরে দণ্ডকারণ্যের (বেশিরভাগই উড়িষ্যা এবং মধ্যপ্রদেশ রাজ্যভুক্ত) শিলাময় এবং আতিথেয়তাশূন্য অঞ্চলে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। যখন ১৯৭৭ সালে বাম-ফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে, তখন তদানীন্তন রাজ্য মন্ত্রী (মার্ক্সিস্ট ফরওয়ার্ড ব্লকের) রাম চ্যাটার্জী দণ্ডকারণ্যের শরণার্থী ক্যাম্পে পরিদর্শনে গিয়েছিলেন এবং তাদের পশ্চিমবঙ্গে ফিরিয়ে আনার মিথ্যে আশ্বাস দিয়েছিলেন।
ভিন রাজ্য হওয়ায় ভাষার বৈচিত্রতা এবং দণ্ডকারণ্যের ঘন জঙ্গল, খাবার পানির অপ্রতুলতা ও ম্যালেরিয়া ডায়রিয়াসহ অন্যান্য প্রতিকূল পরিস্থিতির সাথে খাপ খেতে না পেরে ১৯৭৮ সালে বিপুলসংখ্যক শরণার্থী বাংলায় ফিরতে শুরু করে। কিন্তু তৎকালীন ক্ষমতাসীন বামফ্রন্ট সরকার তাদের রাজ্য-শাসনপ্রণালীতে পরিবর্তন আনে এবং শরণার্থীদের রাজ্যের বোঝা হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের রাজ্যে নাগরিকত্ব প্রদানে অস্বীকৃতি প্রকাশ করে। প্রায় ১,৫০,০০০ মতো শরণার্থী দন্ডকারণ্য ছেড়ে আবার পশ্চিমবঙ্গে ফিরে আসলে উদ্বাস্তুদের কয়েকজনকে আটক ও বিতাড়িত করা হয়। কিন্তু অনেকেই পুলিশি বেষ্টনী উপেক্ষা করে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকতে পেরেছিলো। আর যারা পশ্চিমবঙ্গে ঢুকতে পারে নি, সেই ফেরত আসা শরণার্থীরাই মরিচঝাঁপিতে আশ্রয় নেয় এবং নিজ উদ্যোগে সেখানকার জঙ্গল পরিষ্কার করে বন্যা থেকে বাঁচার জন্য বাঁধ নির্মাণ, মৎস্য চাষ ও চাষাবাদের ব্যবস্থা করে উক্ত দ্বীপে পাকাপাকিভাবে বসবাস করতে শুরু করে। কিন্তু তদানীন্তন ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট সরকার মরিচঝাঁপি দ্বীপে শরণার্থীদের স্বীয় উদ্যোগে এই পূনর্বাসন মেনে নেয় নি এবং উক্ত এলাকাকে সুন্দরবনের সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করে তাদের এই বসবাসকে আইনের লংঘন হিসেবে বিবৃতি দিয়েছিলেন।
কোরানখালি নদীতে পুলিশি অবরোধ বসানো হয় যাতে করে মরিচঝাঁপি দ্বীপের শরণার্থীরা যেন নদী পার হয়ে পাশের কুমিরমারি গ্রাম থেকে ঔষুধ, খাদ্যশস্য, খাবার পানি এবং নিত্য-প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতে না পারে।
১৯৭৯ সালের ৩১ শে জানুয়ারী দুপুরের দিকে রাজ্য সরকারের পুলিশ দল দ্বীপের মধ্যে ঢুকে উদ্বাস্তুদের উপর লাগাতার গুলিবর্ষণ শুরু করে
হত্যার পর পুলিশ ও দলীয় কর্মীরা মৃতদেহগুলোকে নদীতে ফেলে দেয়। আবার অনেকেই নদী সাঁতরে পালাতে গিয়ে ডুবে মৃত্যু হয়।
ঘটনার পঞ্চদশ দিনে কোলকাতা হাই কোর্ট মরিচঝাঁপি দ্বীপে খাবার জল, প্রয়োজনীয় খাদ্য এবং ডাক্তারদের প্রবেশের অনুমতি প্রদান করে শেষতক অর্থনৈতিক অবরোধ দিয়ে পেরে না উঠে তৎকালীন রাজ্যের সিপিআই(এম) সরকার মে মাসের দিকে জোরপূর্বক দ্বীপটিকে খালি করার ব্যবস্থা গ্রহণ করে। সংবাদ মাধ্যমের কর্মীদের উক্ত দ্বীপে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। পুলিশের সহায়তায় দলীয় কর্মীরা মে মাসের ১৬ তারিখ ৩০০ টি পরিবারের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। হত্যাকান্ডের ঘটনার পর দ্বীপে পরে থাকা অবশিষ্ট শরণার্থীদের পুনরায় মল্কানগিরি (উড়িষ্যা), মানা এবং কুরুত (মধ্যপ্রদেশ) এবং আদিলাবাদে (উত্তর প্রদেশে) জোরপূর্বক পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আবার কিছু কিছু শরণার্থী পালিয়ে পশ্চিমবঙ্গের কদম্বগাছি, মালতিপুর, বারাসাত, বর্ধমান, ঘুটিয়াশরিফ, হিঙ্গলগঞ্জ ও ক্যানিং-এ আশ্রয় গ্রহণ করে। [তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া ]
প্রথমবারের মতো ইতিহাসের সেই কালো অধ্যায়কে আবৃত্তিশিল্পী ও লেখক মৃন্ময় মিজানের গ্রন্থনা ও নির্দেশনায় আবৃত্তি প্রযোজনায় তুলে এনেছে আবৃত্তি একাডেমি। আগামী ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, একাডেমির প্রতিষ্ঠার দুই দশক পূর্তি অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারের ( শাহবাগ, ঢাকা ) শওকত ওসমান স্মৃতি মিলনায়তনে সন্ধ্যা ৬টায় এই প্রযোজনাটি শুরু হবে ।
এই অনুষ্ঠানটি উপভোগ করতে অনলাইন রেজিস্ট্রেশন করা যাবে নিচের লিংক এ:
” অনলাইন রেজিস্ট্রেশন লিংক “
এই আবৃত্তি প্রযোজনার বিস্তৃত অংশ জুড়ে রয়েছে মরিচঝাঁপি থেকে উৎখাত হওয়া একজন উদ্বাস্তুর পরাজিত জীবনের দীর্ঘশ্বাস। সাথে আছে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, দেশভাগ, দেশভাগের ফলে বিভক্ত দুই বাংলার মানুষের মনে তৈরি হওয়া ক্ষত এবং নানান রাজনৈতিক টানাপোড়েন। সর্বোপরি ধর্ম ও রাজনৈতিক পরিচয়ের উর্ধ্বে উঠে আমরা যাতে মানুষ হয়ে উঠতে পারি তার আহ্বান রয়েছে এখানে।