ছোট মামা প্রয়াত গোলাম মোস্তফা মোহর। ছোটবেলায় দেখতাম তিনি নাটক, ছোট গল্প, কবিতা এসব লিখতেন। এক সময় তিনি নরসিংদী থেকে লোটাস নামে একটি পত্রিকাও বের করতেন। তার চিন্তা, কাজের ধরন এসবের দারুন প্রভাব অনুভব করতাম নিজের মধ্যে। তাই যখন থেকে বুঝতে শিখেছি, তখন থেকেই মনের মধ্যে একটি স্বপ্নকে লালন করতাম, আমি লেখালেখি করবো। কিংবা গণমাধ্যমে কাজ করবো। বেশ স্পষ্ট মনে আছে ক্লাস সেভেন কিংবা এইটে যখন পড়ি তখন কৃষি বিষয়ক একটি অনুষ্ঠান মাটি ও মানুষ নিয়মিত দেখতাম প্রতিবেদন লেখা শিখতে। পরে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন কেটে সেগুলো নিজের সংগ্রহে রাখতাম। আজন্ম লালিত লক্ষ্য বাস্তবায়নই ছিলো এর উদ্দেশ্য।
গণমাধ্যমে কাজের ক্ষেত্রে আমার প্রথম পছন্দ ছিলো রেডিও। ভয়েস অব আমেরিকার খ্যাতনামা সাংবাদিক জনাব আমীর খসরু ও শেগুফতা নাসরিন কুইন ছিল আমার সেসময়কার অনুসরনীয় আদর্শ। এই মাধ্যমটিতে কাজের জন্য সবচেয়ে জরুরী শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলতে পারা। ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত থাকার সুবাদে বাংলা উচ্চারনে কিছুটা হলেও দখল ছিলো। তবে তা নিজেকে শতভাগ আত্মবিশ্বাসি বলে মনে করার মত না। তাই এ বিষয়ক কোন কর্মশালা করার একটি সুপ্ত বাসনা ছিলো মনের মধ্যে।
২০০৭ সালের শেষের দিকে একটি অনুষ্ঠানে আবৃত্তি একাডেমির সাবেক সমন্বয়ক কামরুল ইসলাম জুয়েল ভাই এবং সাবেক কার্যকরী সদস্য আবু মূসা পলাশ ভাইয়ের সাথে দেখা হয়। তাদের কাছ থেকে জানতে পারি আবৃত্তি একাডেমির কথা। তবে গ্রুপে এসেছি মূলত বন্ধু মাসুদ হাসান রেজা (বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসি ) তার হাত ধরে। একাদশ কর্মশালার মাঝামাঝি এসে দলের অনুমতি নিয়ে ক্লাস করা শুরু করি। ক্লাসের বিষয়গুলো ঠিকভাবে বুঝে উঠতে না পারলে আবৃত্তি একাডেমির সেসময়কার পূর্ণাঙ্গ সদস্য নাঈমা সুলতানা আপার সরণাপন্ন হতাম। তিনি বেশ সহানুভূতি নিয়ে বুঝিয়ে দিতেন। কর্মশালা শেষে দলের প্রাথমিক সদস্যপদ পাই।
দলে সিনিয়ররা কোন কাজ দিলে সব সময়ই চেষ্টা করেছি তা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে। আবৃত্তি একাডেমিতে আমার প্রথম দায়িত্ব পালন কোন একটি পিকনিকে ক্রীড়া বিভাগের সদস্য হিসেবে। এরপর বিভিন্ন পিকনিকে ক্রীড়া বিষয়ক উপ-কমিটির আহ্বায়ক, খাদ্য বিষয়ক কমিটির আহ্বায়ক, পিকনিক সমন্বয়ক, আহ্বায়ক হিসেবে কিংবা প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানের বিভিন্ন বিভাগের সদস্য হিসেবে বেশি কিছু দায়িত্ব পালন করেছি। আমাকে যখন যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তাতে আমি গাফিলতি করিনি কখনো। হয়তো সে বিষয়টিকে বিবেচনা করেই আবৃত্তি একাডেমির কার্যকরী পরিষদ আমাকে পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদ দিয়েছেন। অর্থাৎ দলে পূর্ণাঙ্গ সদস্য হিসেবে আমার অন্তর্ভূক্তি সংগঠক ক্যাটাগরিতে। এক্ষেত্রে একটি অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করা যেতে পারে। সেটি হলো, আবৃত্তি একাডেমির সাবেক পরিচালক অগ্রজ কার্যকরী সদস্য মৃন্ময় মিজান ভাই তার একটি লেখায় আমাকে অভিহিত করেছিলেন ‘হরফুন মোল্লা’ হিসেবে। নামের ব্যাখ্যায় তিনি লিখেছেন- ‘যে সকল কাজের কাজী’।
কবিতার প্রতি ভালোবাসা আমার সব সময়ই ছিলো, তবে আবৃত্তিশিল্পী হতে চাইনি কখনো। কিন্তু এখনও চেষ্টা করলে যে নিজেকে তৈরি করতে পারবো না ব্যাপারটা তাও না। এসেছিলাম সুন্দর করে কথা বলা শেখার জন্য। তবে কোন অদৃশ্য ভালোবাসার টানে যেন কর্মশালা শেষ করলেও দল থেকে প্রস্থান করা আর হয়ে উঠেনি। আবৃত্তি একাডেমির সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার বিষয়টি আমার কাছে মনে হয়, উড়ে এসে জুড়ে বসার মত। পূর্ণাঙ্গ সদস্য হওয়ার পর দলের নির্বাহী কমিটিতে আমি শুধুমাত্র ৪ বছর প্রচার অধিকর্তা হিসেবে কাজ করেছি।এবারও প্রস্তুতি ছিলো আগের মতই কোন দায়িত্ব হয়তো আসবে। যেখানে মাথার উপর অনেকগুলো স্নেহের হাত থাকবে। নির্ভয়ে কাজ করা যাবে। গত বছরে শেষের দিকে এসে দলের কাউন্সিলে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সদস্যদের গোপন ভোটে সমন্বয়ক নির্বাচিত হওয়ার পর দায়িত্ব পালন নিয়ে আমি কিছুটা ভীত হয়ে পড়েছিলাম। একেতো এত বড় একটি সংগঠন, যার বয়স দেড়যুগ পেরিয়ে গেছে এরইমধ্যে, তার ওপর মোট কার্যকরী সদস্যের মধ্যে দুই তৃতীয়ংশের মত নিয়মিত সময় দিতে পারেন না ব্যক্তিগত ব্যস্ততার কারণে। অবশ্য শেষ পর্যন্ত কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সদস্যের পরামর্শ এবং আশ্বাসে দায়িত্ব পালনে রাজি হই। এছাড়া দীর্ঘ দিন পর সরাসরি ভোটে নেতৃত্ব নির্বাচিত হওয়ার পর, সদস্যদের রায় উপেক্ষা করার সুযোগও ছিলনা।
শুরুটা বেশ ভালোভাবে করলেও ব্যক্তিগত কিছু কারনে মাঝে কয়েক মাস ঠিকভাবে দলে সময় দিতে পারিনি। আবার চেষ্টা করছি সবকিছু গুছিয়ে নেয়ার।
অন্যান্য আবৃত্তি সংগঠনের সাথে আবৃত্তি একাডেমির মৌলিক পার্থক্যের জায়গাটি হলো গণতন্ত্র চর্চার বিষয়টিতে। এখানে যেমন প্রতি ২ বছর পর পর নতুন নেতৃত্ব নির্বাচিত/মনোনীত হয় অন্য কেউ এই চর্চাটি করেন না। সেসব সংগঠনে একজন ব্যক্তিই আজীবন সভাপতি কিংবা পরিচালক। আবৃত্তি একাডেমির আর্থিক ব্যবস্থাপনাও শতভাগ স্বচ্ছ। এখানে যেসব শিক্ষার্থী কর্মশালায় অংশ নিতে আসেন তাদের প্রতি দলের জ্যেষ্ঠ সদস্যের আচরণ পরম বন্ধু অথবা অভিভাবকের মত। এখানে একজন নারী শিক্ষার্থী কখনোই দলের সিনিয়র কোন সদস্যের চোখের সামনে নিজেকে অনিরাপদ ভাবেন না, দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া। এটি আমার অভিজ্ঞতা থেকে দেখা।
এখানে যার যে যোগ্যতা আছে তা বিকশিত করতে সবাই সবাইকে সহযোগিতা করেন। পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গাটিও আবৃত্তি একাডেমিতে অনেক মজবুত। তাইতো সারা সপ্তাহ কর্মব্যস্ততার মধ্যে কাটানোর পরও সাপ্তাহিক একটি ছুটির দিনে বিশ্রাম না নিয়ে আমরা ছুটে যাই ডাকসুর বারান্দায়। প্রাণের মিলন মেলায়। ভালোবাসার এই টান আমাকে ২০১৩ সালের নভেম্বরে দেশ টিভি এবং ২০১৬ সালের অক্টোবরে সময় টিভিতে যোগদান করতে দেয়নি।কারন বহু অনুনয় বিনয় করেও গ্রুপের সিটিংয়ের দিন, শুক্রবারে ডে-অফের নিশ্চয়তা ওই ২টি জায়াগা থেকে আমি পাইনি।
আবৃত্তি একাডেমির জন্য এর প্রতিটি সদস্য/প্রশিক্ষনার্থীর যে অকৃত্রিম ভালোবাসা সেটিই আমাদের এগিয়ে যাবার অনুপ্রেরণা। এই নিখাদ আন্তরিকতাই আবৃত্তি একাডেমির প্রাণশক্তি।আপনি আমি যাকে দলের জন্য অপাংক্তেয় মনে করি, সুযোগ পেলে তার সাথে কথা বলে দেখুন। তাকে প্রশ্ন করে জেনে নিন তার হৃদয়ের কোন স্তরে আবৃত্তি একাডেমিকে সে ধারন করে। জবাব যা আসবে তাতে আপনি বিস্মিত হবেন। মনে হবে দলের জন্য আপনার আমার ভালোবাসা তার চেয়েও বুঝি অনেক নীচু স্তরের। আবৃত্তি একাডেমিকে এই অবস্থানে নিয়ে আসতে বহু মানুষের ত্যাগ রয়েছে। কৃতজ্ঞতা যারা এখন দল পরিচালনায় আছেন এবং অতীতে যারা ছিলেন তাদের সবার প্রতি।
ব্যক্তি স্বার্থের সব কালিমাকে পায়ে দলে বৃহত্তর কল্যাণ ও সাফল্যেের পথ ধরে দৃপ্ত পদক্ষেপে আবৃত্তি একাডেমি এগিয়ে যাক বহু দূর এটিই একমাত্র চাওয়া। ভালো থেকো প্রাণের সংগঠন। আবৃত্তি একাডেমি, আমরা তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি ।