আবৃত্তি একাডেমি নিয়ে জুয়েল আদীবের অনুভূতি

গতকাল মধ্যরাতের পর থেকেই ভাবছিলাম কিছু একটা লিখব আবৃত্তি একাডেমি নিয়ে। দুপুরে মজুমদার বিপ্লব দা’র হরবোলা’র জন্মদিন পালনের ছবি এবং সন্ধ্যায় মৃন্ময় মিজান (অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক পরিচালক, আবৃত্তি একাডেমি) ভাইয়ের পোস্ট পড়ে নিজের অনুভুতি প্রকাশের আগ্রহটা আরও বেড়ে গেলো।

আজ আমাদের প্রাণের সংগঠন আবৃত্তি একাডেমি’র জন্মদিন। “উচ্চারিত প্রতিটি কথা হোক শিল্প” -এ শ্লোগানকে ধারণ করে ১৯৯৮ সালের ২৮ আগস্ট এ সংগঠনের অভিযাত্রা। শৈশবেই সংগঠনে ভাঙন হয়ে আজ অনেকটা থিতু হয়ে এগিয়ে চলেছে স্বপ্ন পানে। মৃন্ময় মিজান ভাইয়ের পোস্টে সংগঠনের শুরুর দিককার নানা বর্ণ চড়াই-উতরাই ঘটনা বিধৃত হয়েছে। আমি সেসবের সময় ছিলাম না।

আবৃত্তি একাডেমি’র সঙ্গে ২০০৪ এর দিকে যুক্ত হবার একটা সুযোগ এসেছিলো। এ সময় আমি আমাদের বিভাগীয় কালচারাল ফোরামের সাথে কাজ কররতাম। সে বছর একদিন ডিপার্টমেন্টের Jahangir Akand (সিনিয়র সাংবাদিক, বাংলাভিশন) ভাই সকালের সিটিংয়ে নিয়েও গিয়েছিলো। সেদিনের কথা আবছা মনে পড়ে। সেন্ট্রাল লাইব্রেরির দক্ষিন পাশে সিটিং শেষে হাকিম চত্ত্বরে সবাই চা খেতে আসেন। সেদিনের মুখগুলোর মধ্যে মিজান ভাই ও Dravid Saikot (শিক্ষক, জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল) ভাইয়ের কথা মনে আছে। কিন্তু আমার আর ঐ বছর থেকে কন্টিনিউ করা হয়নি।

একাডেমি’র সঙ্গে আমার পূর্ণ যুক্ততা ২০০৬ এ। ঢাবিসাসে কর্মশালা করার সময় মিজান ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়। তারপর আমাদের কর্মশালার মেম্বার Shirin Kabir ও Shamsunnahar Sharifa মিজান ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি আবৃত্তি একাডেমির সঙ্গে কাজ করার আমন্ত্রণ জানান। আমি যুক্ত হয়ে যাই পুরোপুরিভাবে। সেই বছর আবৃত্তি একাডেমির ষষ্ঠ আবর্তনের ক্লাস চলছিলো, টিএসসি মহড়া কক্ষের ক্লাসে প্রশিক্ষণার্থী খুব বেশি ছিলো না। আমি অনিয়মিতভাবে কয়েকটি ক্লাসে অংশ নিই, যেহেতু সংগঠনের সদস্য হবার অন্যতম একটি পূর্বশর্ত ছিলো কর্মশালায় অংশগ্রহন। এ কর্মশালা থেকেই খন্দকার শামীম মাহমুদ ভাই ও Mumina Tahmina Morshed আমরা এখনো আছি।

আবার এ সময় আমি ঢাবিসাসের আবৃত্তি ও সংবাদ পাঠ কর্মশালার কো-অর্ডিনেশনের দায়িত্ব পালন করতাম, যা ইতোপূর্বে মৃন্ময় মিজান ভাইয়ের এবং Barkatullah Sujon (সিনিয়র সাংবাদিক, এটিএন বাংলা) ভাইয়ের কাঁধে ছিলো। এখান থেকেই একটু আধটু ক্লাস নেয়া শুরু। তারপর তো আবৃত্তি একাডেমিতে কাজ করার সুবাদে বহু জায়গায় ক্লাস নিচ্ছি, একাডেমি থেকে এটা আমার বিশাল প্রাপ্তি অকপট স্বীকার্য। মূলতঃ ক্লাস নেয়ার মাধ্যমে আমি প্রতিনিয়ত শিখছি।

বলছিলাম, আবৃত্তি একাডেমিতে আমার সংশ্লিষ্টতার কথা। সপ্তম আবর্তনে একটু একটু সময় দেয়া। তারপর অষ্টম আবর্তন থেকে কর্মশালার পুরোপুরি দায়িত্ব আমার উপর চলে আসে। মিজান ভাই, Masud Ahammed ভাই, Sharmin Jui আপু ও তুষার মিজান (Mizanur Rahman) ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে সফল কর্মশালা আয়োজনের মাধ্যমে সংগঠনের অগ্রযাত্রা সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলে। এ সময় আমার জিয়া হলের রুমমেট ছোটভাই Abu Musa Palash (সাবেক নির্বাহী, আবৃত্তি একাডেমি) অনেক সহযোগিতা করেছে।

আমি দায়িত্ব পাওয়ার পর কোনো কর্মশালায় ৮০ জনের কম প্রশিক্ষণার্থী ছিলো না, এমনকি সকাল-বিকেল দু’টি কর্মশালাও আয়োজন করতে হয়েছে। প্রায় কর্মশালায় শতাধিক থেকে দেড় শতাধিক সদস্য হয়েছে। অপ্রিয় হলেও সত্য, সে সময় কোনো কোনো সিনিয়রকে খুঁজেও পাওয়া যায়নি। কপর্দকশূন্য সংগঠন আর্থিকভাবেও সাবলম্বী হতে শুরু করেছে প্রত্যেকের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায়। সাবলম্বী সংগঠনের মৌ-লোভী সুখের পাখিদের শৈণ দৃষ্টি অসম্ভব কিছু নয়। আমরা সচেতন থাকলে সংগঠনকে কেউ ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহারের সুযোগ পাবে না নিশ্চয়ই।

একদিনের ঘটনা খুব মনে পড়ছে। ডাকসুর বারান্দায় ক্লাস শুরু করে দিয়ে নীলক্ষেত গিয়েছি। ক্লাস নিচ্ছিলেন ডা. আরু (Aaru Aurangzeb) ভাই। খবর পেলাম ক্লাসের মধ্যে রক্তক্ষয়ী মারামারি শুরু হয়েছে। দ্রুত এসে অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়টি নিষ্পত্তি করি। আমি ও তুষার ভাই পুলিশি ঝামেলা থেকে সংগঠনকে রক্ষা করি। সেদিনের ঘটনা আরেকটু বাড়তে দিলে হয়তো আমাদের সংগঠনটি ক্যাম্পাসে ব্ল্যাক লিস্টেড হয়ে যেতো। এ রকম বহু ছোটো ঘটনা মনকে ইমোশনাল করে দেয়। রাজন ভাই (Rahmatullah Rajon), নিম্মি আপু, টিপু ভাই (Fokhrul Islam Tipu), Mohammad Shamim Ahsan ভাই, Lutful Bari ভাই, বন্ধু মোরশেদ আলমসহ সবার স্নেহ-প্রীতি পেয়েছি। পরবর্তীতে আজ অবধি কত প্রাণের মানুষের সহযোগিতা পেয়েছি, তা বলে শেষ করা যাবে না।

সেই শুরু থেকে কর্মশালার পাশাপাশি সংগঠনের প্রাণসুধা সিটিং ও প্রযোজনা আয়োজন এবং বিভিন্ন প্রকাশনার মানোন্নয়নেও সচেষ্ট হই। ২০০৬ সালে নিয়মিত সিটিংয়ের সিলেবাসটি জিয়া হলের বড়ভাই Liakat Ali Khan (এডিশনাল এসপি) এর কাছ থেকে যখন নিই, দেখতে পাই কবিতাগুলো বিভিন্ন বই থেকে ফটোকপি কাটিং পেস্ট করে তৈরি। তারপর থেকে নিজে আরও দু’একজনের টাইপিং সহযোগিতা নিয়ে কম্পোজ ও প্রিন্টেড সিলেবাস করা শুরু করি। এসবই ভালোবাসা ও ভালোলাগা থেকে করেছি। এসবের মাধ্যমে নিজেকে নতুন করে গুছানো শিখেছি। এ আমার জীবনে প্রিয় আবৃত্তি একাডেমি’র অবদান।

এরপর ত্রুটি-বিচ্যুতিসহ সংগঠনের বহু দায়িত্ব পালন করেছি। জুঁই আপু, তুষার ভাই, ঝুমকা আপু (Tanzina Haque), তুহিন ভাই (Abd Tuhin) ও মিঠু ভাইয়ের পরিচালক/সমন্বয়কের দায়িত্বকালীন আমি অর্থ ও প্রশিক্ষণ অধিকর্তার এবং সর্বশেষ চার বছর (২০১৩-১৬) পিউলী আপুর (Dilshad Jahan) পরিচালনায় সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেছি। এসব দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সংগঠনের জন্য কতটুকু কী করতে পেরেছি তা সময়ের বিবেচনাধীন। তবে আমার কাছে বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, আমি সমৃদ্ধ হয়েছি বিভিন্নভাবে এবং সান্নিধ্য পেয়ে আসছি কিছু ভালো মানুষের। সময়ের ব্যবধানে মানব মানসিকতার পরির্তন হতে পারে, তবু চাই স্নেহ-প্রীতি-শ্রদ্ধার সম্পর্কগুলো অটুট থাকুক। নিজের স্বার্থের চাইতে আবৃত্তি একাডেমি’র স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে চাই শেষাবধি।

সৃষ্টি করা যতটা কঠিন, ধ্বংস করা ততটাই সহজ। কারও ক্ষতি করা যতটা সহজ, উপকার করা ততটা সহজ নয়। আমাদের প্রাণের প্রয়াস দীর্ঘজীবী হোক, জয় হোক আবৃত্তি একাডেমি’র। জন্মদিনের এ শুভক্ষণে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সকল সদস্য ও শুভার্থীর ক্ষুদ্র অবদানকেও কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি, করবো। আমার বিশ্বাস, স্বার্থান্বেষী ও পরশ্রীকাতরের বিনাশ অবশ্যম্ভাবী। চাতুর্যহীন ভালোবাসা ও শুভকর্মের উদ্ভাসন অবধারিত। বর্তমান প্রিয় পরিচালক প্রকৌশলী মাসুদ ভাই এবং উদ্যমী সমন্বয়ক মনজুর হোসাইন এর জন্য শুভ কামনা। অশুভ ভ্রুকুটি হেরি ভবিষ্যতের পথচলা আরও মসৃন হোক অনাগত কাণ্ডারীদের। সঙ্গে আছি, থাকবো।

নির্মোহ একরাশ প্রীতি ও শুভেচ্ছা প্রাণাস্পদ আবৃত্তি একাডেমি ও সহমর্মী আবৃত্তি একাডেমি পরিবারের জন্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *