আবৃত্তির প্রতি ভালোলাগা মোটামুটি ছিল। সেই ছোটবেলায় নতুন কুড়ি দেখে ধারণা…কিন্তু তখন আবৃত্তিকে নিজের মধ্যে ধারণ করা ছিল না।
স্পষ্ট মনে আছে যখন ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ার তখন কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তেমন কেও অংশগ্রহন করছিল না। বাংলা ম্যাডাম সবাইকে ঘাড়ে ধরে বিভিন্ন পর্বে এক একজনকে নাম লেখাচ্ছিল। বাংলা ম্যাডামের পাড়াপাড়িতে অনেকেই নাম দিচ্ছিলো। তবে মোটামুটি সবাই গানে নাম লেখাচ্ছিলো। যখন ম্যাডামের নজরে পরে গেলাম আমারো এবার কোন কোন পর্বে নাম লেখাতেই হবে। কিন্তু গান!!!! সুর তো গলা দিয়ে কখনই বের হবে না শুধু শুধু সবার হাসির পাত্র হবার কোন মানে হয় না…আর অভিনয় এও কখনই সম্ভব হবার নয়। তখন ম্যাডাম বলেছিল কেন শুধু গান আর অভিনয় আবৃত্তি কি করা যায় না। তখন হুট করে মাথায় ঢুকলো আসলেই তো এই একটা জিনিষ তো চেষ্টা করাই যায়।
সবার অনেক অনেক রিহার্সেল…কোন কিছুতেই আমি নাই। কারণ সবার ধারণা আবৃত্তি কি চর্চা করার মতো কিছু হলো!
অবশেষে অনুষ্ঠানের দিন আবৃত্তি করলাম আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ‘মাগো ওরা বলে’ এখন যেটা কোন এক মা কে নামে পরিচিত। আমি ভাবতে পারিনি তার পরিনতি কি হবে। আমার ভাবনা বাদ দিলাম… পুরো কলেজ কি…পুরো এলাকা এমন কি আমার ছোট ভাই বোনদের ক্লাসমেট থেকে শুরু করে স্যার ম্যাডাম সবাই খুব প্রশংসা করেছিল। আমাদের বাসা থেকে স্কুল খুব দূরে ছিল না। আম্মু অপেক্ষা করছিল কখন আমি আবৃত্তি করবো।বাসায় আসার পর আম্মু বলেছিল মাইকে তোমার কন্ঠ একদমি চেনা যায় না…
সেই অনুষ্ঠানের পরপরই কলেজের স্যার ম্যাডামরা আমাকে সাভার আন্ত কলেজ আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় পাঠালো। আমি তো আকাশ থেকে পরলাম। কিভাবে কি করবো… কি আবৃত্তি করবো…কিছুই মাথায় ঢুকছিলো না। বাংলা ম্যাডাম বললেন যেটা অনুষ্ঠানে করেছ সেটাই কর। অবশেষে প্রতিযোগিতায় অংশ নিলাম…না…কোন পুরস্কার পাই নি। সেদিন প্রথম জেনেছিলাম আবৃত্তিতে কি কি ব্যাপারে মার্কিং করা হয়। আমার কবিতা গনার মধ্যেও ধরেনি…কারণ আমি কবি নজরুল কিংবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোন কবিতা আবৃত্তি করিনি।
তারপর তিতুমীর কলেজে অনার্সে ভর্তি হলাম। সেখানে দেখলাম বিশাল একটা সাংস্কৃতিক ফোরাম আছে। সেখানে নাচ, গান, অভিনয়, আবৃত্তি সব কিছুর চর্চা হয়। সেখানে আবৃত্তিতে যোগ দিলাম। ভাবলাম যে জিনিসটা না যেনে করেছি এখন সেটার একটু চর্চা করি। কিন্তু সেখানেও আশানুরুপ কিছু পেলাম না। সেখানে মাহবুবের সাথে পরিচয়…ও ভাল আবৃত্তি করে…যাকে আমরা লম্বু মাহবুব বলি। আর এক ছিল মনোয়ারা…আমার ফোরামের বান্ধুবী…যাকে আমি সাবানা বলতাম। ও দেখতে ঠিক সাবানার মতো ছিল। ফোরাম থেকে যখন তেমন কিছু শিখার ছিল না আমি ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছিলাম তখন মনোয়ারা আমাকে এক প্রকার জোর করে টি.এস.সিতে আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্রে ভর্তি করাবে। কারণ লম্বু মাহবুব বলেছিলো ওখানে নাকি যারা তোতলা তারাও সুন্দর করে কথা বলতে শিখে যায়। তাই মনোয়ারা টি.এস.সিতে আবৃত্তি চর্চা শুরু করবে। ওর সঙ্গী হিসেবে আমাকেও যোগ দিতে হবে। তখন সম্ভবত ভর্তির জন্য ৫০০টাকা লাগতো। আমার কাছে এই টাকা ছিল না বলে আমি বলেছিলাম আমি ভর্তি হব না। কিন্তু মনোয়ারা যে ভর্তি হবেই…কিন্তূ একা একা তো আর যাওয়া আসা সম্ভব না তাই ওই ৫০০টাকা দিয়ে আমাকেও ভর্তি করালো। কোথায় ভর্তি হলাম…আবৃত্তি একাডেমি তে… আমাদের আবৃত্তি একাডেমি। আমি ক্লাস একটাও ঠিক মত করতে পারিনি। শুক্রু, শনি ক্লাস হত। যখন আবৃত্তি একাডেমির ক্লাস হত সে সময় আমার একাউন্টিং আর ফাইন্যান্স এর প্রাইভেট ক্লাস থাকতো। আবৃত্তি ক্লাসে তাই আমাকে কেউ চিনতো না। তারপর চাকরীতেও যোগ দিলাম। শুক্রবার সকালটায় শুধু ফ্রী থাকতাম। অতঃপর যখন প্র্যাক্টিকাল ক্লাস শুরু হল প্রতি শুক্রবার সকালে তখন প্রতিদিন যাওয়া শুরু করলাম।
ওই সময়টায় মিজান ভাই সিটিং পরিচালনা করতেন। আবৃত্তি করার জন্য কত ধরণের ব্যায়াম করতে হয় আর কত কিছু যে চর্চা করতে হয় তা আগে কখনো কল্পনাও করি নি। প্রতি সিটিং এ সবাইকে কবিতা পরতে হতো। কেও কবিতা না পরলে তাকে যথেষ্ট কথা শনা লাগতো। আমি প্রথম দিকে কবিতা পরতাম না। লম্বু মাহবুব তখন বলেছিলো তুমি যদি সিটিং এ কবিতা না পড় তাহলে তোমার কোথায় ভুল হচ্ছে কেউ ধরতে পারবে না… তোমার কোন উন্নতিও হবে না…আর এখানে শুধু যাওয়া আসাই হবে… কোন লাভ হবে না। তারপর থেকে আমি কবিতা পড়া শুরু করলাম। সিটিং এ আমার পরা প্রথম কবিতা হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পায়ে চলার পথ। আমার মনে হয় সেদিনই আমি বড় ভাইয়া আপুদের নজরে পরেছিলাম। মিজান ভাই বলতো প্রশংসাতো সবাই করে আমরা এখানে প্রশংসা করবো না। আমরা ভুল ধরার চেষ্টা করবো। ভাইয়া সবার কাছ একজনের পরা কবিতা সম্পর্কে জানতে চাইতো। মিজান ভাই এও বলতো শোনার মত কান না বানাতে পারলে কখনো ভালো আবৃত্তি করতে পারবে না।
প্রতি শুক্রবার সিটিং এ না গেলে দিনটাই মাটি মনে হতো। সবার সাথে দেখা সাক্ষাত করতে যাব বা আড্ডা দিতে যাব তা না। নতুন কিছু শিখা হবে…কবিতা পড়া হবে তাই যাওয়া। তারপর শুরু হলো মাসিক আবৃত্তি প্রতিযোগিতা। আমার এখনো মনে পরে সেই দিনটার কথা। প্রতিযোগিতার অনেক আগেই কিছু নিয়ম কানুন বলে দেওয়া হয়েছিল। কবিতা দেখে পড়লে ১ নম্বর কাটা যাবে। সময় মত যে উপস্থিত হবে না সে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারবে না। আর বাকী সব নিয়ম তো সব সময়কার মতো। প্রতিযোগীতার দিন একদম সময় মত এসে হাজির হলাম আশুলিয়া থেকে। মিজান ভাই যখন বলেছে তখন নিশ্চই জিনিস গুলো পালন হবে। ঠিক তাই, মনোয়ারা ৯টা বাজার ২/৩ মিনিট পর এসেছিল তাই ও প্রতিযোগীতায় অংশ নিতে পারে নি। আমরা সবাই কবিতা মুখুস্থ করে গিয়েছিলাম। আবৃত্তি শুরু করার আগে দেখি ভাই বলছে কবিতা পড়তে হবে সবার সামনে এসে দাঁড়িয়ে। সবার আগে কবিতা পড়েছিলো সঞ্জয়। ও মাঝপথে এসে কবিতা ভুলে গেল। ওকে দেখে আমাদের সবার অবস্থাও খারাপ। এরপর যেই যাচ্ছে সেই কবিতা ভুলে যাচ্ছে… আমি পড়েছিলাম বাইবেলের কালো অক্ষরগুলো… আমিও কবিতা ভুলেই গিয়েছিলাম। শামীম মাহমুদ ভাই একমাত্র ছোট একটা কবিতা পড়েছিল… প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলেন।
প্রত্যেকটা সিটিং এত প্রানবন্ত ছিলো… প্রতিদিন মনে হত নতুন কিছু শিখছি। ধীরে ধীরে আবৃত্তি ভাললাগা থেকে ভালবাসায় পরিনত হলো। আমার গ্রুপে যোগ দেওয়ার পর প্রথম বড় প্রযোজনা হল জুলফিকার ভাইয়ার বিক্ষিপ্ত সময়ের বুকে জেসাসের পদধ্বনি। সেখানে নতুনদের মধ্যে একমাত্র আমাকে আবৃত্তি করতে দেওয়া হয়েছিল। খুবই কঠিন একটা কবিতা। তারপর থেকে ছোট কোন প্রযোজনা হোক কিংবা বড় সবগুলোতেই আমার অংশগ্রহণ ছিল। প্রতিটা প্রযোজনায় অংশগ্রহণ এর কারণ শুধুই মঞ্চে ওঠা ছিল না…এক একটা প্রযোজনাকে মঞ্চস্থ করার পেছনে কতশত রিহার্সেল হত…কত শ্রম যে ব্যয় হত তার সাথে মিশে থাকতো আবৃত্তির প্রতি ভালবাসা…আবৃত্তি একাডেমির প্রতি ভালবাসা…
এতো সময় ধরে আবৃত্তি একাডেমির সাথে আছি…এতদিন ধরে আবৃত্তি করছি…কতবার মঞ্ছে টেলিভিশনে পারফর্ম করেছি…এখনো কবিতা পড়তে গেলে আমি নার্ভাস হয়ে যাই… কিন্তু সেটা যদি হয় শুধুমাত্র মৃন্ময় মিজান ভাই সামনে থাকেন। এখনো কোন প্রযোজনা হলে সেটাতে কাজ করার লোভ সামলাতে পারি না… তার কারণ এই নয় যে আবার মঞ্চে উঠবো…নতুন অনেক কিছু শিখতে পারবো…একটা উদাহরণ দেই…
মৃন্ময় মিজান ভাই এর প্রযোজনায় কাজ করার শুরুতে বোঝার উপায় নেই যে কি নিয়ে কাজ করবো…যা নিয়ে কাজ করা হবে তার বাইরের সব কবিতা নানা ভাবে উনি পড়তে বলতেন। যেভাবে আবৃত্তি করবো সেভাবে না…তার বাইরে গিয়ে পড়তে হবে। শুরুর দিকে আমি উচ্চস্বরে পড়তে পারতাম না…আমার কন্ঠে কান্না ভাব আনতে পারতাম না…একবার রিহার্সেল পার হয়ে গেল শুধু দূর থেকে ডাকলে কিভাবে ডাকতে হবে সেটা দেখিয়ে…শেষ পর্যন্ত আমি সেটা করে দেখাতে পারি নি। আর মৃন্ময় মিজান ভাই এর রিহার্সেল কোন দিন সময়ের চেয়ে ১ সেকেন্ড পরে কখনো হয় নি। সময়ের ব্যাপারটা আমার প্রথম প্রযোজনায় কাজ করা জুলফিকার ভাইয়ার বিক্ষিপ্ত সময়ের বুকে জেসাসের পদধ্বনিতেও দেখেছিলাম। মাসুদ ভাইয়ের পুঁথি নাটক মহুয়াতে তো পুরো সময়টাই আমাদের লেগেছে ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষা শেখার পিছনে। জুঁই আপুর নির্দেশনায় নক্ষত্রের পানে চেয়ে বেদনার পানে ছিলো আমার আবৃত্তি জীবনের প্রথম শ্রুতি নাটক। শ্রুতি নাটক সম্পর্কে এর আগে আমার কোন ধারণা ছিল না। পিউলী আপুর নির্দেশনায় এখন পর্যন্ত কোন কাজ করার সৌভাগ্য আমার এখনো হয় নি। কিন্তু খুব ইচ্ছা আছে কাজ করার।
গত ২৮ আগস্ট আবৃত্তি একাডেমির ১৭ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী গেল… অথচ তার ধারের কাছেও আমি নেই…গত বছরও এত্তো বড় করে আবৃত্তি একাডেমির প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী অনুষ্ঠিত হলো…তার সাথে থাকি থাকি করেও শেষ পর্যন্ত থাকা হলো না। অথচ যখন বড়সড় করে কয়েকদিন ব্যাপী প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী করার কথা চিন্তা করা হতো তখন আমরা ধ্যই ধ্যই করে নাচতাম।
সময়…ব্যাস্ততা আর বাস্তবতার কারণে আবৃত্তি থেকে…আবৃত্তি একাডেমি থেকে দূরে আছি ঠিকই…… কিন্তু আবৃত্তি একাডেমি কখনই আমার ভালবাসার জায়গা থেকে সরে যাবে না। আজকে আমার ব্যাক্তিত্বের পুরোটাই গড়েছে আবৃত্তি একাডেমি। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত আবৃত্তি একাডেমির সাথে থাকতে চাই…আবৃত্তি একাডেমির কর্মী হয়ে কাজ করে যেতে চাই।